“This land is your land, and this land is my land
From California to the New York Island
From the Redwood Forest to the Gulf Stream Waters
This land was made for you and me”
১৯৪০ সালে যখন আমেরিকা মাত্রই The Great Depression মহামন্দা থেকে উঠে আসে, লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারায়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর ভাঙা স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে, তখনো ধনী ও ক্ষমতাশালীরা নিজেদের স্বার্থে নীতিনির্ধারণ করে চলছিলো। সে সময় Woody Guthrie নিজ চোখে আমেরিকার “land of opportunity” মিথ ভেঙে পড়তে দেখে এ গান রচনা করেন। সম্প্রতি গানটি আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত এটি আমেরিকার বঞ্চিতদের গান।
গণসঙ্গীত মানে শুধু সুর আর কথা নয়, এটি মানুষের প্রতিবাদের ভাষা, বিপ্লবের আত্মবিশ্বাস, আর বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বর। বিশ্বজুড়ে গণসঙ্গীত বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। চাষির অধিকার, শ্রমিকের দাবি, বর্ণবৈষম্য, উপনিবেশবিরোধিতা কিংবা নারীর স্বাধীনতাসহ সব ক্ষেত্রেই।
কিন্তু এই গণসঙ্গীতের সুর বা সংগীতধারা কীভাবে গড়ে উঠল? এটি কী নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য বা অঞ্চলের সংগীতের উপর নির্ভরশীল? নাকি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার ফল?
গণসঙ্গীতের সুর সাধারণত ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত, নৃত্য সংগীত এবং জনপ্রিয় আনন্দের সুর থেকে নেওয়া হয়। আসামের আনন্দোচ্ছল প্রেমরসাত্মক নৃত্যের বিহু গানের সুর বহু গণসঙ্গীতের সুরের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
লোকসংগীতের কণ্ঠে ভর করেই মূলত গণসঙ্গীতের জন্ম। লোকসঙ্গীত নিজেই জনগণের গান, খেটে খাওয়া মানুষের, চাষির, শ্রমিকের বা যাযাবর সমাজের সুর। গানগুলো সহজ ভাষায়, স্বল্পসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র দিয়ে পরিবেশিত হয় এবং এর মধ্যে থাকে জীবনসংগ্রামের কাহিনি। যখনই সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণি নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তখন এই লোকগানই তাদের রক্তচিৎকারের মতো গেয়ে উঠেছে।
আমেরিকার ‘ব্লুজ’ এবং ‘স্পিরিচুয়ালস’ গান ছিল কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। পরবর্তীতে এগুলিই রূপ নিয়েছিল আন্দোলনের সঙ্গীতে। ওডেটা, বব ডিলান বা উডি গাথরির গাণে আমরা এ প্রভাব দেখতে পাই। গাথরির “This Land Is Your Land” গানটি চট করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বঞ্চিতদের গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়।
লাতিন আমেরিকার “Nueva Canción” আন্দোলন শুধু সুর আর প্রতিবাদ নয়, ছিলো সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। ভিক্টর হারা, মার্সেডেস সোসা, এবং ইনতিল্লিমানির মতো শিল্পীরা লোকসুরের ওপর ভিত্তি করে গড়েছেন উপনিবেশবিরোধী, সাম্রাজ্যবিরোধী সংগীত। তাদের গান মূলত আদিবাসী মেলোডি, লোকবাজনা এবং স্প্যানিশ গীটারের সংমিশ্রণে তৈরি।
তাদের এই সংগীতধারা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে এক নতুন ধারা। জন্ম দেয় আন্দোলন ভিত্তিক সাংস্কৃতিক একতা, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিলো স্থানীয় ঐতিহ্য, রাজনৈতিক বার্তা এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ের আকুতি।
উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে আফ্রিকার গণসঙ্গীত ছিলো রণতুর্য। নাইজেরিয়ার ফেলা কুতি ‘আফ্রো-Beat’ ব্যবহার করে সরাসরি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সুর তুলেছিলেন। তাঁর গানে ছিলো আফ্রিকান লোকবাদ্য, জ্যাজ এবং ইউরোপীয় হারমোনির মিল। গান হয়ে উঠেছিলো রাজনৈতিক ভাষ্য।
এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘টাউনশিপ জ্যাজ’ ও ‘মিবাগান’ ধারার গানগুলো বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছিল। গানগুলোতে ছিলো স্থানীয় ঐতিহ্য, ছন্দ এবং ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণ।
ভারতে গণসঙ্গীতের সুর এসেছে মূলত দুটি জায়গা থেকে, ভক্তি ও বাউল ধারার সহজ ভাষার সুর ও আদিবাসী ও আঞ্চলিক লোকগান।
ভারতের তেলেঙ্গানা আন্দোলন থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন পর্যন্ত নানা পর্বে গণসঙ্গীত অনেক ছিল প্রভাবশালী। কালজয়ী গান “হাম দেকে ঙ্গে আজাদি” বা গণনাট্য সংঘের গানগুলোর মূল ভিত্তিও ছিল লোকসংগীত থেকে অনুপ্রাণিত।
বাংলাদেশের গণসঙ্গীত প্রধানত এসেছে পল্লীগীতি, বাউল, ভাটিয়ালি ও লালনসংগীতের ঐতিহ্য থেকে। সালিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, আর পরবর্তীকালে ফকির আলমগীর, সুফিয়া কামাল সহ সাম্প্রতিক সময়ের ‘জলের গান’-এর মতো দলগুলোর গান এই ধারার সমসাময়িক রূপ। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও গণসঙ্গীতের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” বা “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে” গানগুলো হয়ে ওঠে আন্দোলনের অনুষঙ্গ।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব গণসঙ্গীতের নতুন ধারা সৃষ্টি করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সে গণসঙ্গীতের সুর এসেছে পুরোনো ব্যালাড, ধর্মীয় স্তব ও ‘চ্যান্ট’ থেকে। ফরাসি বিপ্লবের গান “লা মার্সেইয়েজ” একদিকে জাতীয় সংগীত, অন্যদিকে গণসঙ্গীতের আদর্শ উদাহরণ।
আধুনিক ইউরোপীয় গণসঙ্গীতের মধ্যে পরিবেশবাদী আন্দোলন, ফেমিনিজম, LGBTQ অধিকার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গানগুলোতে যেমন আছে ট্র্যাডিশনাল ফোকের ছোঁয়া, তেমনি আছে রক, র্যাপ, ইলেকট্রনিক সংগীতের আধুনিক প্রয়োগ।
বিশ্বায়নের ফলে গণসঙ্গীতের সুর এখন আর একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আজকের গণসঙ্গীত হলো আন্তঃসাংস্কৃতিক রসায়ন। ইন্টারনেট, ইউটিউব এবং স্ট্রিমিং সার্ভিসের মাধ্যমে এক অঞ্চলের আন্দোলনের গান সহজেই ছড়িয়ে পড়ে অন্য অঞ্চলে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের গান “Alright” (কেন্ড্রিক লামার) এখন ল্যাটিন আমেরিকান বা আফ্রিকান আন্দোলনেও শোনা যাচ্ছে।
অন্যদিকে অনেক বিশ্বব্যাপী পরিচিত সুর ‘বেলা চাও’ ইতালির প্রতিরোধ আন্দোলনের গান হলেও আজ তা গাওয়া হয় হংকং থেকে ভারত-বাংলাদেশ পর্যন্ত সর্বত্র। আমরা দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী জনমানুষের বঞ্চনার কন্ঠ কিভাবে ধীরে ধীরে হয়ে উঠে বৈশ্বিক সম্পদ।
গণসঙ্গীতের সুরের উৎস খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাবো বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস। প্রকৃত অর্থে এটি এসেছে লোকসংগীত থেকে, বঞ্চিতদের হৃদয়ের গভীরতম ব্যথা থেকে এবং কখনও কখনও গীর্জা বা মাজারের্র গলি থেকে।
গণসঙ্গীত কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সংস্কৃতির কোনো একচেটিয়া সম্পদ না, এটি মানুষের স্বাধীন চেতনাবোধের সুর হয়ে কাল, স্থান ও সংস্কৃতি অতিক্রম করে সকল নিপীড়িতের হৃদয়ে আশ্রয় নেয়।


